সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:১৫ পূর্বাহ্ন
ধর্ম ডেস্ক:
কোনো জাতির অস্তিত্ব ও স্বকীয়তা রক্ষার জন্য একতার বিকল্প নেই। এটা একটি অখণ্ডিত শক্তি, যা সহজেই খণ্ডন করা যায় না। কোনো সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ জাতিকে সহজেই কেউ নিশ্চিহ্ন ও পরাজিত করতে পারে না। সংঘবদ্ধতা, ত্যাগ ও সংগ্রাম-সাধনার মাধ্যমেই হতে পারে কোনো জাতি বিজয়ী, অর্জন করতে পারে সম্মান, সাফল্য ও উন্নতি। যেকোনো শত্রুই এমন জাতিকে সমীহ করে চলতে বাধ্য।
অন্যদিকে অসংগঠিত বিশৃঙ্খল জাতি কোনো অবস্থাতেই উন্নতির চূড়ায় আরোহণ করতে পারে না। নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক হানাহানিতেই তাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। বিশ্বদরবারে এমন হীনজাতির কোনো মর্যাদা নেই। এ ধরনের জাতি নিজেদের মান-সম্মানের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে, খর্ব করে নিজেদের অধিকার। এমন জাতির পক্ষে নিজেদের অস্তিত্ব, সভ্যতা-সংস্কৃতি, ভাষা, জাতীয় বৈশিষ্ট্য এবং জীবনব্যবস্থা ও জীবনাদর্শের হেফাজত করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব হয় না। লাঞ্ছনা, পরাশাসন, অধঃপতন, ও নিষ্পেষণই জুটে থাকে এসব জাতির ভাগ্যে।
মুসলিম উম্মাহ এমন এক জাতি, যারা ছড়িয়ে আছে সারা বিশ্বে। মুসলমানরা যদি ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত না হয়, তবে অমুসলিমদের শাসনই চলতে থাকবে তাদের ওপর। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে তারা বিলীন হয়ে যাবে অমুসলিমদের মধ্যে।
মুসলমানরা আদর্শের বাহক। আমাদের দ্বারাই ইসলামের আদর্শের ধারা বাস্তবায়িত হবেযদি গঠন করতে পারি একতা ও সংঘবদ্ধতা। ঐক্যবদ্ধহীন জনগোষ্ঠী সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে যাবে অতল গহ্বরে। বিচ্ছিন্নতা ডেকে আনবে ঐক্যের বিনাশ। প্রকাশ পাবে অনৈক্য, ফেতনা-ফ্যাসাদ, যা ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই দেবে না। ইতিহাস সাক্ষী, মুসলিম উম্মাহর বিচ্ছিন্নতা যুগে যুগে তাদের মাঝে ফেতনা-ফ্যাসাদ ঢেলে দিয়েছে। মাথাচাড়া দিয়েছে ইসলামবিদ্বেষী শক্তি। অতএব মুসলিম উম্মাহর জন্য সংঘবদ্ধতার প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
সংঘবদ্ধ থাকার ব্যাপারে ইসলাম অস্বাভাবিক গুরুত্বারোপ করেছে। মুসলমানদের মধ্যে যেন কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা না দেয়, সে ব্যাপারেও অসংখ্য নির্দেশনা রয়েছে। মুসলমানরা কীভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে থাকবে সে বিষয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা একযোগে আল্লাহর রজ্জু সুদৃঢ় রূপে ধারণ করো ও বিভক্ত হয়ে যেয়ো না এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহর যে দান রয়েছে তা স্মরণ করো। যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে তখন তিনিই তোমাদের অন্তঃকরণে প্রীতি স্থাপন করেছিলেন, অতঃপর তোমরা তার অনুগ্রহে ভ্রাতৃত্বে আবদ্ধ হলে এবং তোমরা অনল-কুণ্ডের ধারে ছিলে, অনন্তর তিনিই তোমাদের তা হতে উদ্ধার করেছেন; এরূপে আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় নিদর্শনাবলি ব্যক্ত করেন, যেন তোমরা সুপথপ্রাপ্ত হও।’ সুরা আলে ইমরান : ১০৩
বর্ণিত আয়াতে আল্লাহকে ভয় করার কথা বলার পর, ‘তোমরা একযোগে আল্লাহর রজ্জু সুদৃঢ় রূপে ধারণ করো’এর আদেশ দিয়ে এ কথা পরিষ্কার করে দিলেন যে, মুক্তি রয়েছে এই দুই মূলনীতির মধ্যে এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এই মূলনীতির ভিত্তিতে।
অতঃপর ‘পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’এর মাধ্যমে দলে দলে বিভক্ত হওয়া থেকে নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাৎ উল্লিখিত দুটি মূলনীতি থেকে যদি তোমরা বিচ্যুত হয়ে পড়ো, তাহলে তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। বলাবাহুল্য, বর্তমানে দলে দলে বিভক্ত হওয়ার দৃশ্য আমাদের সামনেই রয়েছে। কোরআন-হাদিস বোঝার এবং তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ নিয়ে পারস্পরিক কিছু মতপার্থক্য থাকলেও তা বিভক্ত হওয়ার কারণ নয়। এ ধরনের বিরোধ তো সাহাবি ও তাবেয়িনদের যুগেও ছিল, কিন্তু তারা ফেরকা সৃষ্টি করেননি এবং দলে দলে বিভক্ত হননি। কারণ, তাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও সবার আনুগত্য ও আকিদার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল একটি। তা হলোকোরআন ও হাদিসে রাসুল (সা.)। কিন্তু যখন ব্যক্তিত্বের নামে চিন্তা ও গবেষণা কেন্দ্রের আবির্ভাব ঘটল, তখন আনুগত্য ও আকিদার মূলকেন্দ্র পরিবর্তন হয়ে গেল। আপন আপন ব্যক্তিরা এবং তাদের উক্তি ও মন্তব্যসমূহ প্রথম স্থান দখল করল এবং আল্লাহ ও তার রাসুলের উক্তিসমূহ দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হলো। আর এখান থেকেই মুসলিম উম্মাহর মধ্যে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা শুরু হলো; যা দিনে দিনে বাড়তেই লাগল এবং বড় শক্তভাবে বদ্ধমূল হয়ে গেল।
মনে রাখতে হবে, মুসলমানরা সবাই এক উম্মত; তাদের থেকে কেউ আলাদা কোনো দল করে পৃথক হলে সে উম্মতের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ঘটাল। এটা শরিয়তে নিন্দনীয়। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জান্নাতের সর্বোত্তম অংশে বসবাস করে আনন্দিত হতে চায়, সে যেন ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরে।’ জামে তিরমিজি
হজরত রাসুলে আকরাম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে জীবনযাপন করো, সংঘবদ্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবনযাপন করো না, কারণ বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করলে শয়তানের কু-প্ররোচনায় আকৃষ্ট হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।’ সুনানে আবু দাউদ
আরেক হাদিসে (ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত) হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সংঘবদ্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু।’ সহিহ মুসলিম
বর্ণিত আয়াত এবং হাদিস থেকে স্পষ্ট হলো
মুসলিমদের অবশ্যই সংঘবদ্ধ থাকতে হবে।
কখনো ঐক্য থেকে বের হয়ে মুক্ত জীবন কাটানো যাবে না।
ঐক্য বা সংঘবদ্ধ থেকে বের হওয়া মানেই ইসলামের মূলনীতি থেকে বের হয়ে যাওয়া।
মুসলমানদের ঐক্য ও সংঘবদ্ধতা আল্লাহর বিশেষ এক নিয়ামত।
আমির বা নেতার আনুগত্য করতে হবে।
ঐক্যবদ্ধ ছাড়া সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত থাকা সম্ভব নয়।
দলাদলি, বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্নতা মুসলমানদের জন্য অকল্যাণকর।
ঐক্যের ভিত্তি হবে হাসবুনাল্লাহ অর্থাৎ কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)
মোদ্দা কথা, একতাবিহীন কোনো কিছুই সম্ভব নয়। ঐক্য অবশ্যই জরুরি। বিচ্ছিন্নতা যেমন একটা জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে, তেমন ঐক্যও পৌঁছে দিতে পারে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে। তাই আমাদের জন্য উত্তম হলো, ঐক্যবদ্ধ জীবন গঠন করা।
ভয়েস/আআ